আমার সব বাজেটই নির্বাচনী বাজেট

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, আমার প্রতিটি বাজেটই নির্বাচনী বাজেট। আমি একজন রাজনীতিক, একটি দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। দলের নীতিনির্ধারণে আমি ভূমিকা রাখি। তাই আমার প্রতিটি বাজেটই রাজনৈতিক বাজেট হবে, নির্বাচনী বাজেট হবে— এটাই স্বাভাবিক। আমি আগেই বলেছিলাম, এবারের বাজেটে নতুন করে কর দেওয়া হবে না। তা রাখতে পেরেছি। দেশ এক সময় দরিদ্র, অনাহারি, অভাবী মানুষের ছিল। সেই দেশ এখন উন্নত। গ্রামে এখন মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। মঙ্গা আজ জাদুঘরে চলে গেছে। দেশে এখন আর কোথাও কোনো অভাব নেই। গতকাল রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে রীতি অনুযায়ী বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি রয়েছে। এটা আমি আগেও বলেছি। কিন্তু ব্যাংকিং কমিশনটা আমি এবার করছি না। এটা অনেক ওপর থেকে আমাকে জানানো হয়েছে। ফলে এটার সব কাগজপত্র আমি গুছিয়ে রেখেছি। এটা পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে যাচ্ছি। পরবর্তী সরকার এসে সেটা করবে। এত বড় বাজেট, সামনে জাতীয় নির্বাচন। একটি বাজেট বাস্তবায়ন করবে তিনটি সরকার, বর্তমান, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচনে বিজয়ী দলের গঠিত সরকার। এতে বাস্তবায়নে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে কিনা— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ নির্বাচন কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। এবার দেরিতে শুরু হচ্ছে। তবে যত দেরিতে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হবে ডিস্টার্ব তত কম হবে বলে তিনি মনে করেন। সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান একই সারিতে উপস্থিত ছিলেন। পেছনের সারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীর, অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, ইআরডি সচিব শফিকুল আজম ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সচিব ড. এম শামসুল আলম উপস্থিত ছিলেন। তাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে অর্থমন্ত্রীকে সহায়তা করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, অনেকেই এই বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট বলছেন। সাধারণত প্রতিবার নির্বাচনের হাওয়া এপ্রিলে লেগেই যায়। এবার এই হাওয়া লাগতে একটু দেরিই হচ্ছে। এটা দেশের জন্য ভালো। কারণ হাওয়া কম হলে কাজে বাধা আসবে না। কাজ বেশি হবে। যেহেতু এখনো নির্বাচনের হাওয়া শুরু হয়নি, নির্বাচনের বছরের বাজেট বাস্তবায়ন তাই ততটা খারাপ হবে না বলে মনে হচ্ছে। এটা দেশের জন্য সুখবর। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে কিনা— জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, লক্ষ্যমাত্রা হলো একটা এস্টিমেট। অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। বাজেট করতে গিয়ে অনেক ধরনের ঘাটতি থাকে, সমস্যা থাকে। আমরা সেগুলোকেও বিবেচনায় নিয়ে বাজেট তৈরি করি এবং বাস্তবায়নও করি। এবারের বাজেটে আমরা যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি, সেটা ঠিকই আছে এবং আশা করি কোনো সমস্যা হবে না। তবে বাজেট ঘাটতি দিন দিন কমে আসছে। আগামীতে আরও কমবে। তিনি আরও বলেন, ১০ বছর ধরে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। এর মূল নায়ক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, করপোরেট কর হার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে কোনো দেশেই করপোরেট করের হার এত বেশি নয়। আমরাও সেই মান অনুযায়ীই এটাকে কমানোর চেষ্টা করছি। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির করপোরেট করের হার কমানো হয়নি। ব্যাংক খাতকে সুবিধা দেওয়ার জন্যই এটা করা হয়েছে কিনা— এ প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এর আগে আমাদের ব্যাংকের জন্যও করপোরেট করের হার ছিল ৪০ শতাংশ। এটাকে কমিয়ে কমিয়ে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশে নিয়ে এসেছি। ৪০ শতাংশের ওপরে করপোরেট কর হার খুব কম দেশেই আছে। তবে তামাক ও মোবাইলসহ কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া বাকি কোম্পানিগুলোর জন্য এটা যেমন ছিল তেমনই থাকবে। যেসব কোম্পানি ৪০ শতাংশের কম হারে করপোরেট কর দেয়, তাদেরটা কেন কমাব? তবে ধীরে ধীরে সার্বিকভাবে করপোরেট করের হার কমিয়ে আনা হবে। বাজেট নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান অর্থমন্ত্রী।  তিনি বলেন, বাজেট নয়, প্রশ্নের মাধ্যমে অহেতুক সমালোচনা করা হচ্ছে। এসব প্রশ্ন যারা করেন, তারা দেশের কোনো উন্নয়ন দেখতে পারেন না। তিনি বলেন, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ। আপনাদের যখন জন্ম হয়েছে কিংবা জন্মের আগে, দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ। বোঝেন, কোথায় ছিল বাংলাদেশ এবং এখন কোথায় এসেছে? এই কিছু দিন আগে দেশে ৩০ শতাংশ মানুষ ছিল গরিব। ৭ বছর আগে সাড়ে ৩০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল, আর আজকে সেটা ২২ দশমিক ৪ শতাংশ। যারা চূড়ান্ত গরিব বা হতদরিদ্র তাদের সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ। এখন সেটা ১১ শতাংশ। কোন মুখে আপনারা বলেন, এই দেশে গরিব মারার বাজেট হচ্ছে, ধনীকে তেল দেওয়ার বাজেট হচ্ছে? আপনারা কি বোঝাতে চাচ্ছেন দেশের উন্নয়ন কিছুই হয়নি? অন্য এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে যে মুনাফা আসে, এই হার স্থায়ী না। এটা ২-৩ বছর পর পর রিভিউ হয়। বাজেটের পর এটা নিয়ে আবার বসব। আবার এর হার নিয়ে রিভিউ করব। দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য যেসব দেশে আমাদের ১২ হাজার শ্রমিক আছে বা থাকবে, সেই দেশেই নতুন শ্রম অফিস খোলা হবে। সে লক্ষ্যে আমরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছি। আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ানোর স্বার্থে ব্যাংকিং চ্যানেলকে যতটুকু সহায়তা করা দরকার, তার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি, যেন অবৈধ উপায়ে বা হুন্ডির মাধ্যমে কোনো অর্থ দেশে না আসে।

আপনার কাছে কী জাদু আছে, সীমিত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পরও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন কীভাবে হচ্ছে— এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সীমিত সম্পদের বাস্তবসম্মত ব্যবহারের কারণে বিনিয়োগ কম হলেও প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ছে এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এটা একবারে নয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত নেওয়া হবে। বাকি থাকে ২০ বিলিয়ন ডলার। তা খুব বেশি নয়। এ ছাড়াও ঋণ পরিশোধেও আমরা খুব ভালো অবস্থানে রয়েছি। এটা একটা রেকর্ড। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন নজির নেই। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে যোগ করে ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আজম বলেন, বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ১৯৮ মার্কিন ডলার। এই মুহূর্তে ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক ঋণ জমা আছে। প্রতিবছর ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়, যা মোটেও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তিনি আরও বলেন, এ বছর ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় হবে। ১ বিলিয়ন পরিশোধের পরেও আমাদের হাতে ৫ বিলিয়ন ডলার জমা থাকবে। প্রতিবছর আমাদের ২ হাজার কোটি টাকা সুদ দিতে হয়, যা খুবই নমিনাল।

যারা বাজেটকে ভুয়া বলে তাদের দেশপ্রেম জিরো : বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, বিএনপি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘ভুয়া’ অভিহিত করেছে। অর্থমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘এই বাজেট কীভাবে ভুয়া হতে পারে? কিছু নির্বোধ ছাড়া এটা আর কেউ বলতে পারে না। যারা এই বাজেটকে ভুয়া বলছেন, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাদের দেশপ্রেম জিরো। এ ছাড়া এমন কথা কেউই বলতে পারে না।

প্রসঙ্গ রোহিঙ্গা : অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও পুরো টাকা খরচ করতে হবে না। সামান্য কিছু টাকা ব্যয় হবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করা অর্থ এ পর্যন্ত বিদেশি অনুদান থেকে পাওয়া গেছে। এটি আগামী বছরও পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করা অর্থের সংস্থান করতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে কথা হচ্ছে। সেখান থেকেও অর্থ পাওয়া যাবে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদের হার নামিয়ে আনতে ব্যাংকিং খাতকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ছাড় দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা। সুদের হার কম হলে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বাড়াতে পারবেন। তাতে বিনিয়োগ বাড়বে। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, আমরা যে সম্পদ আহরণ করি তার ব্যবহার খুব ভালো, তাই হাই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার এগিয়ে আছে। গত বছর সরকার দেশে ১৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। আমরা ১০ লাখ লোককে বিদেশে পাঠিয়েছি। যারা একসময় গৃহে কাজ করতেন, যাদের কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না, এমন প্রায় ১৩ লাখ মানুষকে কর্মসংস্থানের আওতায় আনা হয়েছে। যে পরিমাণ জনগোষ্ঠী কর্মজীবনে আছেন, তার চেয়ে বেশি জনগোষ্ঠীকে আমরা কর্মসংস্থানের আওতায় আনতে পেরেছি, এটি আমাদের বড় অর্জন।

অর্থমন্ত্রী এখন আর বিশ্বভিক্ষুক নন : অর্থমন্ত্রী বলেন, একটা সময় ছিল যখন বিভিন্ন দেশের লোকেরা বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীকে বিশ্বভিক্ষুক হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। এখন তো সেটা নেই। আমরা এখন স্বাবলম্বী। তার কথার সঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী যোগ করেন, একসময় যে পাশ্চাত্য আমাদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ ও ‘হতাশার ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল, আমাদের অগ্রগতি দেখে তারাই এখন প্রশংসা করছে। জাতিসংঘের মহাসচিব ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ আখ্যা দিয়েছেন। আর আমরা এখন আর বিশ্বভিক্ষুকের জাতি নই।

ব্যাংকিং কমিশন হচ্ছে না : অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি সব কাগজপত্র গুছিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু উপরের নির্দেশে এ কমিশন এবার আর হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাত অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু অনেকেই ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। আকারে বাড়লেও সেবা সেভাবে বাড়েনি। ব্যাংকিং কমিশন আমি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আর করছি না। এ জন্য কাগজপত্র সব তৈরি করে রেখে দিচ্ছি, আগামী সরকারের জন্য। আগামীতে যে সরকার আসবে তার জন্যই এটা রেখে যাচ্ছি।

অনলাইন কেনাকাটা ভ্যাটমুক্ত : অর্থমন্ত্রী বলেন, অনলাইন বেশ পপুলার হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে অনলাইনে পণ্য বা সেবা কেনাবেচা ভ্যাটমুক্ত রয়েছে। বাজেটে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেটা ছাপানোর ভুল বলে জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, আমরা ভার্চুয়াল বিজনেস যেমন ইউটিউব, ফেসবুক এগুলোর ওপর ট্যাক্স ধার্য করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। কিন্তু অনলাইন বিজনেস আমরা আলাদা করেছি এবং এটার ওপর ভ্যাট বসাইনি।

  • ব্রেকিংবিডিনিউজ২৪ / ০৯ জুন ২০১৮ / তানজিল আহমেদ