বিয়ে করা কখন ফরজ, কখন নিষিদ্ধ?

বিয়ে হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে দুইজন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতিভেদে বিয়ে সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও সাধারণভাবে বিয়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যৌন সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। কিছু সংস্কৃতিতে, য কোন প্রকারের যৌন কর্মকাণ্ডে প্রবৃত্ত হওয়ার পূর্বে বিয়ে সম্পন্ন করাকে বাধ্যতামূলক হিসেবে পরামর্শ দেওয়া হওয়া অথবা বিবেচনা করা হয়।

বিশদ বিবৃত সংজ্ঞার ভাষায় বলতে গেলে, বিয়ে হল একটি বৈশ্বিক সার্বজনীন সংস্কৃতি। বিয়ে সাধারণত কোন রাষ্ট্র, কোন সংস্থা, কোন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ, কোন আদিবাসী গোষ্ঠী, কোন স্থানীয় সম্প্রদায় অথবা দলগত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা স্বীকৃত হতে পারে। একে প্রায়শই একটি চুক্তি হিসেবে দেখা হয়। সাধারণত আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় অথবা ধর্মনিরপেক্ষ আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। বৈবাহিক কার্যক্রম সাধারণত দম্পতির মাঝে সমাজ-স্বীকৃত বা আইনগত দায়িত্ববোধ তৈরি করে, এবং এর মাধ্যমে তারা বৈধভাবে স্বেচ্ছায় সন্তানসন্তানাদির জন্ম দিতে পারে।

বিশ্বের কিছু স্থানে, পরিবার-পরিকল্পিত বিয়ে, শিশু বিয়ে, বহুবিয়ে এবং জোরপূর্বক বিয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে পালিত হয়। বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিক আইন ও নারী অধিকার বিষয়ক উদ্যোগের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত বিয়েররীতিগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনগত স্বীকৃতির ক্ষেত্রে, অধিকাংশ সার্বভৌম রাষ্ট্র ও অন্যান্য বিচারব্যবস্থা বিবাহকে দু’জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সীমিত করে এবং এদের মধ্যে হাতে গোনা কিছু রাষ্ট্র বহুবিবাহ, শিশুবিবাহ এবং জোরপূর্বক বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়।

বিগত বিংশ শতাব্দীতে এসে, ক্রমবর্ধমানভাবে বহুসংখ্যক রাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিচারব্যবস্থা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিয়ে, আন্তঃধর্মীয় বিয়ে এবং অতি সাম্প্রতিকভাবে সমলিঙ্গীয় বিয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে এদেরকে আইনগত স্বীকৃতি নিয়েছে। কিছু সংস্কৃতি তালাকের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেয় এবং কিছু স্থানে রাষ্ট্রের আইনগত নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও শিশুবিয়ে এবং বহুবিয়ে সংঘটিত হয়ে থাকে। বিয়ের মাধ্যমে পরিবারের সূত্রপাত হয়।

এছাড়া বিয়ের মাধ্যমে বংশবিস্তার ও উত্তরাধিকারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিয়ের মাধ্যমে পরস্পর সম্পর্কিত পুরুষকে স্বামী (পতি) এবং নারীকে স্ত্রী (পত্নী) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। স্বামী ও স্ত্রীর যুক্ত জীবনকে “দাম্পত্য জীবন” হিসাবে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন ধর্মে বিয়ের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত। একইভাবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন প্রথায় বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিয়ে মূলত একটি ধর্মীয় রীতি হলেও আধুনিক সভ্যতায় এটি একটি আইনী প্রথাও বটে। বিয়েবহির্ভুত যৌনসঙ্গম অবৈধ বলে স্বীকৃত এবং ব্যাভিচার হিসাবে অভিহিত একটি পাপ ও অপরাধ। মহান আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ে বিধান দিয়েছেন বিশেষ হেকমত সামনে রেখে। সেসব হেকমত থেকে এখানে কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে

১. মানববংশ বিস্তার করা ও ধ্বংসের হাত থেকে মানববংশকে হেফাজত করা। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে : ‘তোমরা কুমারী ও অধিক সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারীদের বিয়ে করো। কেননা কেয়ামতের দিন আমি আমার উম্মতের সংখ্যার আধিক্য দিয়ে অন্যান্য উম্মতের ওপর গর্ব করব। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২০৫০)

২. বিয়ে চক্ষু শীতল করে। হাদিস শরিফে এসেছে : ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা (আর্থিক ও দৈহিকভাবে) বিয়ে করতে সক্ষম, সে যেন বিয়ে করে। কেননা এটি চক্ষু শীতল করে ও লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে। আর যে অক্ষম, তার জন্য রোজা রাখা জরুরি। এই রোজা তার জন্য জৈবিক চাহিদা প্রতিরোধক। ’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০৫; মুসলিম, হাদিস : ১৪০০)

৩. বিয়ের মাধ্যমে অন্তরের অসওয়াসা ও অবৈধ কামনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে এসেছে : ‘তারা তাদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে, তাদের পত্নী বা অধিকারভুক্ত দাসিদের ছাড়া। এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। ’ (সুরা : মা’আরেজ, আয়াত : ২৯-৩০)

৪. বিয়ের মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হয়। বিবাহের মাধ্যমে লজ্জাস্থান হেফাজত হয়। এতে জান্নাতে যাওয়া সহজ হয়। হাদিস শরিফে এসেছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে তার দুই ঠোঁটের মাঝখান (জিহ্বা) ও দুই রানের মাঝখান (লজ্জাস্থান) নিরাপদ রাখার বিষয়ে গ্যারান্টি দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের গ্যারান্টি দিচ্ছি। ’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৬৪৭৪)

৫. যে ব্যক্তি নেককার নারীকে বিয়ে করল, সে ইসলামের পথে ক্রমাগ্রসর হলো। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা যাকে একজন নেককার স্ত্রী দান করেছেন, তিনি তাকে ইসলামের পথে অর্ধেক অগ্রসর করে দিয়েছেন। এবার অবশিষ্ট অর্ধেকের জন্য তার উচিত আল্লাহকে ভয় করা। ’ (মুসতাদরাক হাকেম : ২/১৬১) ইমাম জাহাবি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।

৬. বিয়ের মাধ্যমে অন্তরের প্রশান্তি বাড়ে। কর্মমুখর দিন শেষে ক্লান্তশ্রান্ত দেহে স্বস্তি আসে স্ত্রীর মাধ্যমে। জাগতিক জীবনের শত কোলাহল, কষ্ট মানুষ সহ্য করে প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একজন ব্যক্তি থেকে। তা থেকেই তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৮৯)

৭. অনেকগুলো পরিবারের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হয়। তাই সমাজের অন্তর্গত পারিবারিক বলয় যত সুদৃঢ় হবে, সমাজও তত সুদৃঢ় হবে। মহানবী (সা.)-এর আচার-আচরণ, চালচলন নিজের জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে সহানুভূতি ও স্নেহময় ছিল। বর্ণিত আছে, ‘আয়েশা (রা.) পেয়ালার যেখানে মুখ রেখে পান করতেন, রাসুল (সা.) সেখানে মুখ রেখে পান করতেন এবং একই হাড্ডির গোশত আয়েশা (রা.) খেয়ে রাসুল (সা.)-এর হাতে দিলে রাসুল (সা.) সেখান থেকেই খেতেন, যেখান থেকে আয়েশা (রা.) খেয়েছেন। ’ (নাসাঈ : হাদিস : ৭০)

৮. নেক সন্তান জন্ম দিলে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পাওয়া যাবে। মৃত্যুর পরও এর সুফল ভোগ করা যাবে। হাদিস শরিফে এসেছে : ‘মানুষ যখন মারা যায়, তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিন ব্যক্তির আমল চলমান থাকে। এক. সদকায়ে জারিয়ামূলক কাজকর্ম (যেমন—মসজিদ, মাদ্রাসা করা, রাস্তাঘাট করা, মানবসেবায় কোনো কাজ করা)। দুই. তাঁর রেখে যাওয়া জ্ঞান, যা থেকে মানুষ উপকৃত হয়। তিন. নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করতে থাকে। ’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ১৬৩১)

মানব জীবনে বিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ইসলামে বিয়েকে ঈমানের অর্ধেক বলা হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমেই ঈমানের পূর্ণতা পাওয়া যায়। বিয়ে মানব জীবনের অন্যতম চাহিদাও বটে। বিয়ে শুধু শারীরিক চাহিদা বা ঈমাণ পূর্ণ করে তাই নয়, পুরুষের ব্যক্তিত্বেরও বিকাশ ঘটায়। সমাজে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। এজন্য সময়মতো বিয়ে করাকে গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। যারা বিয়ের উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে করে না, তাদেরকে শয়তানের দলভূক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হজরত আবু জর রা. থেকে বর্ণিত, একবার রাসুলুল্লাহ সা. আক্কাফ রা. কে বললেন, হে আক্কাফ! তোমার স্ত্রী আছে? তিনি বললেন, না। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তোমার কি সম্পদ ও স্বচ্ছলতা আছে? তিনি বললেন, আছে। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তুমি এখন শয়তানের ভাইদের দলভূক্ত। যদি তুমি খ্রিস্টান হতে তবে তাদের রাহেব (ধর্ম গুরু) হতে। নিঃসন্দেহে বিয়ে করা আমাদের ধর্মের রীতি। তোমরা কি শয়তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাও? শয়তানের কাছে নারী হলো অস্ত্র।

সবাই নারী সংক্রান্ত ফেৎনায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যারা বিয়ে করেছে তারা নারীর ফেৎনা থেকে পবিত্র। নোংড়ামি থেকে মুক্ত। তারপর বলেন, আক্কাফ! তোমার ধ্বংস হোক। তুমি বিয়ে কর নতুবা তুমি পশ্চাৎপদ মানুষের মধ্যে থেকে যাবে। [মুসনাদে আহমদ, জমউল ফাওয়ায়েদ, ইমদাদুল ফাতওয়া : ২/২৫৯]। ইসলামে ব্যক্তির স্বাবলম্বী ও সক্ষমতার বিভিন্ন ধরণসাপেক্ষে বিয়েকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

ওয়াজিব বিয়ে : যখন শারীরিক চাহিদা থাকে এবং এই পরিমাণ সামর্থ্য থাকে যে তার এবং স্ত্রীর প্রতিদিনের খরচ বহন করতে পারবে, তখন বিয়ে করা ওয়াজিব। এ অবস্থায় বিয়ে থেকে বিরত থাকলে গুনাহগার হবে।

ফরজ বিয়ে : যদি সামর্থ্য থাকার সাথে সাথে চাহিদা এতো বেশি থাকে যে, বিয়ে না করলে ব্যাভিচার বা হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তখন বিয়ে করা ফরজ। মানব জীবনে বিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ইসলামে বিয়েকে ঈমানের অর্ধেক বলা হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমেই ঈমানের পূর্ণতা পাওয়া যায়। বিয়ে মানব জীবনের অন্যতম চাহিদাও বটে। বিয়ে শুধু শারীরিক চাহিদা বা ঈমাণ পূর্ণ করে তাই নয়, পুরুষের ব্যক্তিত্বেরও বিকাশ ঘটায়। সমাজে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। এজন্য সময়মতো বিয়ে করাকে গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। যারা বিয়ের উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে করে না, তাদেরকে শয়তানের দলভূক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সবাই নারী সংক্রান্ত ফেৎনায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যারা বিয়ে করেছে তারা নারীর ফেৎনা থেকে পবিত্র। নোংড়ামি থেকে মুক্ত। তারপর বলেন, আক্কাফ! তোমার ধ্বংস হোক। তুমি বিয়ে কর নতুবা তুমি পশ্চাৎপদ মানুষের মধ্যে থেকে যাবে। [মুসনাদে আহমদ, জমউল ফাওয়ায়েদ, ইমদাদুল ফাতওয়া : ২/২৫৯]। ইসলামে ব্যক্তির স্বাবলম্বী ও সক্ষমতার বিভিন্ন ধরণসাপেক্ষে বিয়েকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

সুন্নত বিয়ে : যদি শারীরিক চাহিদা প্রবল না থাকে, কিন্তু স্ত্রীর অধিকার আদায়ের সামর্থ্য রাখে তখন বিয়ে করা সুন্নত। এ অবস্থায় খারাপ কাজের প্রতি ঝোঁকার আশঙ্কা না থাকলে বিয়ে না করলে কোনো অসুবিধা নেই।

নিষিদ্ধ বিয়ে : যদি কারো আশঙ্কা হয় সে স্ত্রীর অধিকার আদায় করতে পারবে না। চাই তা দৈহিক হোক বা আর্থিক। তার জন্য বিয়ে করা নিষিদ্ধ। সামর্থ্য না থাকলে।

রোজা রাখা : অনেকের বিয়ের ইচ্ছে আছে, সক্ষম পুরুষও কিন্তু স্ত্রীকে ভরণ পোষণ দেয়ার ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় বিয়ে না করে রোজা রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে হাদিসে। কারণ রোজা দৈহিক কাম উত্তেজনা দূর করে দেয়। এ সময় সক্ষমতা অর্জনের জন্য বেশি বেশি কাজ ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে।