খেলার দুনিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবলের চেয়ে বড় ঘটনা হয়তো আর কিছুই হয় না, কারণ আর কোনো টুর্নামেন্টই পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষকে এমন পাগল করে তুলতে পারে না।
এ টুর্নামেন্টে খেলছে ৩২টি দেশ, কিন্তু যেসব দেশ এতে খেলছে না – সেখানকার মানুষরাও বিশ্বকাপ নিয়ে একই রকম মেতে ওঠেন, ফুটবলের আবেদন এমনই সার্বজনীন।
বিশ্বকাপের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে অনেক মজার মজার তথ্য বেরিয়ে আসে। খেলা এবং তার পরিসংখ্যান নিয়ে যারা মশগুল হয়ে থাকেন -তারা এরকম নানান কিছু ইতিহাস ঘেঁটে খুজে বের করেন।
প্রথম বিশ্বকাপ, মন্টিভিডিও, উরুগুয়ে
প্রথম বিশ্বকাপ হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার উরুগুয়ের রাজধানী মন্টিভিডিওতে। সেবার কোন কোয়ালিফাইং পর্ব ছিল না, অনেকগুলো ইউরোপিয়ান দেশকে সরাসরি খেলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ফিফা। কিন্তু জাহাজে করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে মন্টিভিডিও যেতে সে যুগে সময় লাগতো দু’সপ্তাহ।
তাই ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতে এত দূর যেতে রাজিই হয়নি অনেক ইউরোপিয়ান দেশ। শেষ পর্যন্ত মাত্র চারটি ইউরোপীয় দেশ গিয়েছিল – তারা হলো: বেলজিয়াম, রোমানিয়া, যুগোস্লাভিয়া আর ফ্রান্স।
ব্যবস্থা হয়েছিল, একই জাহাজে চেপে একাধিক ইউরোপিয়ান দেশের খেলোয়াড়রা মন্টিভিডিও যাবেন।
রোমানিয়ার দলটি ‘এসএস কন্তে ভার্দে’ নামের জাহাজে উঠেছিল ইতালির জেনোয়া বন্দর থেকে । ১৯৩০ সালের ২১শে জুন ফ্রান্সের ফুটবল দল জাহাজে উঠলো ভিয়েফ্রাঁসে-সু -মে বন্দর থেকে। শুধু তাই নয় – সে জাহাজে আরো উঠলেন, ফিফার প্রেসিডেন্ট জুল রিমে স্বয়ং, নেয়া হলো প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফিটি, এবং তিনজন রেফারিকে। পথে বার্সেলোনা থেকে সেই জাহাজে উঠলো বেলজিয়াম দল।
পথে আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার পর রিও ডি জেনেইরো থেকে ব্রাজিল দলটিও উঠলো একই জাহাজে। ১৪ দিনের সাগর ভ্রমণ শেষে ৪ জুলাই এরা সবাই মন্টিভিডিও পৌঁছালেন।
যুগোস্লাভিয়া দল মন্টিভিডিওতে গেল ফ্লোরিডা নামে আরেকটি জাহাজে করে -তাদের জাহাজ ছেড়েছিল মার্সেই বন্দরে থেকে।
এর সাথে তুলনা করুন এবারের বিশ্বকাপের – মস্কো থেকে সাড়ে আট হাজার মাইল দূরের অস্ট্রেলিয়া বা আর্জেন্টিনা থেকে বিশ্বকাপ দলের বিমানে করে রাশিয়া পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ১৮-১৯ ঘণ্টা।
বিশ্বকাপে খেললে চাকরি যাবে না
প্রথম বিশ্বকাপে রোমানিয়া দলটি নির্বাচন করেছিলেন সেদেশের রাজা দ্বিতীয় ক্যারল। তা ছাড়া, যেহেতু বিশ্বকাপে যেতে-আসতেই লাগবে প্রায় ৩০ দিন আর তার পর ১৭ দিন ধরে টুর্নামেন্ট। তাই এত দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থাকলে যাতে জাতীয় দলের ফুটবলারদের চাকরি চলে না যায়, সে জন্য নিয়োগদাতাদের সাথে সমঝোতাও করেছিলেন তিনি।
দীর্ঘ ভ্রমণের সময় জাহাজেই কিছু শরীরচর্চা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের ফিট রেখেছিলেন খেলোয়াড়রা।
প্রথম বিশ্বকাপে যোগ দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের নয়টি দেশ।
শত শত কোটি টাকার টুর্নামেন্ট
বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে লাভজনক ক্রীড়ানুষ্ঠান। জনপ্রিয়তা এবং সারা দুনিয়াব্যাপী টিভি দর্শকের সংখ্যার বিচারে বাণিজ্যিক দিক থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
গত ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে ফিফার আয় হয়েছিল ৪৮০ কোটি ডলার, এর মধ্যে ২১৪টি দেশে টিভিতে খেলা দেখানোর স্বত্ব থেকেই আয় হয় ২৪০ কোটি ডলার। স্পন্সরশিপ থেকে আসে ১৬০ কোটি ডলার।
গত বিশ্বকাপে সব খরচের পর ফিফা নেট মুনাফা করে ২৬০ কোটি ডলার।
এ বছর বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশ সব মিলিয়ে পাবে কমপক্ষে ৯৫ লাখ ডলার করে।
চ্যাম্পিয়ন দেশ প্রাইজ-মানি পাবে ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
বিদেশী ম্যানেজার দিয়ে কি বিশ্বকাপ জেতা যায়?
গত ২০টি বিশ্বকাপে যে দলই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে – তাদের ম্যানেজারও ছিলেন সেই দেশেরই । জাতীয় দলের ম্যানেজার বিদেশী হলে কি তাহলে বিশ্বকাপ জেতা অসম্ভব? দেখা যাক, এবার তা কেউ ভুল প্রমাণ করতে পারে কিনা।
এ পর্যন্ত ২০টি বিশ্বকাপের সবগুলোই জিতেছে কোনো না কোনো ইউরোপের দেশ (১১ বার) বা দক্ষিণ আমেরিকান দেশ (৯ বার)।
ব্রাজিল হচ্ছে একমাত্র দেশ যারা বিশ্বকাপের প্রতিটি চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে।
বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হয়েও কোন দল দ্বিতীয় পর্বে উঠতে পারে নি – এমন হয়েছে মাত্র একবার, ২০১০-এর বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা।
প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্বাগতিক দেশই বিশ্বকাপ জিতেছে।
আগেরবার হিরো, পরেরবার জিরো
গত দুটি বিশ্বকাপে-ই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দেশ গ্রুপ পর্বেই ছিটকে গেছে। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে ছিটকে যায় তার আগের বারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি, আর সেবারের চ্যাম্পিয়ন স্পেনও চার বছর পর ২০১৪-র বিশ্বকাপে এসে গ্রুপ পর্ব পেরুতে পারে নি।
১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ী জিনেদিন জিদানের ফ্রান্সও পরের বার অর্থাৎ ২০০২ সালে গ্রুপ পর্বে ছিটকে গিয়েছিল। তিনটি খেলায় একটিও গোল করতে পারে নি তারা, আর খেয়েছিল তিনটি গোল।
বিশ্বকাপের গ্রুপ তালিকা দেখে ফুটবল পন্ডিতরা একটা-দুটো গ্রুপকে নাম দেন ‘গ্রুপ অব ডেথ’ বলে। কিন্তু আসলে মাঠে নামার পর দেখা যায় – যে কোন গ্রুপই যে কোন দলের জন্য গ্রুপ অব ডেথ হয়ে উঠতে পারে । এটাই বিশ্বকাপের বাস্তবতা।
পর পর দুই বিশ্বকাপ জয়!
এবার ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। তারা যদি এবার বিশ্বকাপ জেতে তাহলে তারা হবে গত ৭৬ বছরের মধ্যে পর পর দুটি বিশ্বকাপ জেতা প্রথম দেশ।
এর আগে একমাত্র ব্রাজিল এটা করতে পেরেছিল । তারা পর পর ১৯৫৮ আর ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ জিতেছিল।
সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড়
মেক্সিকোর ২৮ জনের দলে আছেন ৩৯ বছর বয়স্ক রাফায়েল মার্কুয়েজ। তিনি যদি মাঠে নামেন তাহলে তিনি হবেন পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলা তৃতীয় খেলোয়াড় ।
এর আগে পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলেছেন মাত্র দু’জন । একজন জার্মানির লোথার ম্যাথাউস, আর দ্বিতীয়জন মেক্সিকোরই আন্তোনিও কারবাহাল।
মিশরের গোলকিপার এসাম এল-হাদারি যেদিন মাঠে নামবেন সেদিন তার বয়েস হবে ৪৫। তাহলে তিনিই হবেন বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড়।
এর আগের রেকর্ড ছিল কলম্বিয়ার ফারিড মনড্রাগনের। তিনি ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলেছিলেন ৪৩ বছর তিন দিন বয়েসে।
ইউরো জয়ীরা কি বিশ্বকাপের ফেভারিট হয়?
ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগাল যদি এবার বিশ্বকাপ জেতে – তাহলে তারা হবে চতুর্থ দেশ যারা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পরই বিশ্বকাপ জিতেছে।
আগে এ কৃতিত্ব দেখিয়েছে পশ্চিম জার্মানি (এখন শুধুই জার্মানি), ফ্রান্স আর স্পেন।
মেক্সিকো হচ্ছে এমন একটি দেশ যারা একবারও শিরোপা না জিতে সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপ খেলেছে – মোট ১৬ বার।
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন কে?
এই তালিকার দিকে তাকালে আপনি দেখবেন পেলে-ম্যারাডোনার মতো অনেক বহুল আলোচিত তারকার নাম আসছে বেশ পেছনের দিকে।
বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা – মোট ১৬টি।
দ্বিতীয় স্থানে আছেন ২০০২ সালের সেই ন্যাড়ামাথা ব্রাজিলিয়ান রোনাল্ডো – যার পুরো নাম রোনাল্ডো লুই নাজারিও দে লিমা। তিনি বিশ্বকাপে গোল করেছেন মোট ১৫টি।
তৃতীয় স্থানে পশ্চিম জার্মানির গের্ড মুলার (১৪টি) আর চতুর্থ স্থানে ফ্রান্সের জুস্ত ফঁতেইন (১৩টি)। পঞ্চম স্থানে আছেন ব্রাজিলের পেলে (১২টি)। আর্জেন্টিনার দিয়েগো ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ গোল ৮টি।
আর এবারে খেলছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ গোলও করেছেন একজন জার্মান – টমাস মুলার – মোট ১০টি।
জুল রিমে কাপ হাতে ইংল্যান্ড দল, ১৯৬৬
প্রথম বিশ্বকাপের ট্রফিটির নাম ছিল জুল রিমে কাপ – ফিফার সেসময়কার প্রেসিডেন্টের নামে। সেটি ছিল ১০ সেন্টিমিটার উঁচু সোনার তৈরি পাখা-ছড়ানো পরীর মূর্তি।
ট্রফিটি প্রথমবার চুরি হয় ইংল্যান্ডে ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে। লন্ডনে এক প্রদর্শনী থেকে এডওয়ার্ড ব্লেচলি নামে এক সাবেক সৈনিক এটি চুরি করে। পুলিশ তাকে ধরতে পারলেও ট্রফিটি পায়নি।
পরে দক্ষিণ লন্ডনের নরউড এলাকার একটি পার্কে হেঁটে বেড়ানোর সময় ডেভ করবেট নামে এক ব্যক্তির কুকুর ‘পিকলস’ সেই ট্রফি খুঁজে পায় ২৭ মার্চ।
তিনবার বিশ্বকাপ জেতার পর ১৯৭০ সালে ব্রাজিলকে চিরতরে দিয়ে দেয়া হয় জুল রিমে ট্রফি – কিন্তু ১৯৮৩ সালে তা হারিয়ে যায়।
আর কখনোই তা পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় চোরেরা কাপটি গলিয়ে সোনা হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে। তবে এর ভিত্তিটি সংরক্ষিত আছে জুরিখের ফুটবল মিউজিয়ামে।
খেলা কোথায় কোথায় হবে?
রাশিয়া একটি বিশাল দেশ। এতই বড় যে রাজধানী মস্কো থেকে পূর্ব প্রান্তের ভ্লাডিভস্টক পর্যন্ত ট্রেনে করে যেতে আপনার সময় লাগবে প্রায় সাত দিন।
এত বড় দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে তাই খেলাগুলো রাখা হয়েছে মূলত রাশিয়ার ইউরোপের-নিকটবর্তী অংশে, যাতে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগে।
খেলাগুলো হবে মস্কো, সেন্ট পিটার্সবুর্গ, কালিনিনগ্রাদ, ভলগোগ্রাদ, সোচি, রোস্টভ-অন-ডন, ইয়েকাতেরিনবার্গ, কাজান, সামারা, সারানস্ক, নিঝনি-নভোগরদ – এই শহরগুলোতে।
ফুটবল গুন্ডা এবং দাঙ্গাবাজদের এবার কিভাবে সামলানো হবে?
রাশিয়ায় ২০১৬ সালে যখন ইউরো টুর্নামেন্ট হয়েছিল – তখন ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে বেশ গুরুতর সংঘর্ষ-দাঙ্গা হয়েছিল।
কিন্তু এবার বিশ্বকাপের সময় যেন তা না হয় সেজন্য রাশিয়া আশ্বাস দিয়েছে। চিহ্নিত ফুটবল-গুন্ডাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং ইউরোর সময় যারা গোলমাল করেছিল, তাদের কাউকে আসতে দেয়া হবে না – বলছেন কর্মকর্তারা।
বিশ্বকাপের ফাইনাল হবে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে, ১৫ জুলাই।