প্রতিবার রোজার শুরুতে ঠিক করি, এবার আর চানরাতে কোনো হুড়োহুড়ি করব না। মানে কোনো কাজ বা কেনাকাটা ঈদের আগের রাতের জন্য ফেলে রাখব না। কখনো কখনো এমন হয়েছে ঈদের দিন যে পোশাকটি পরব, সেটাও ওই চানরাতেই কেনা হয়েছে। সে কারণে আমার বন্ধুরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে থাকে আমার ওপর। সেই বিরক্তিকে পাত্তা না দিয়ে তাদের সঙ্গে চানরাতে বেরিয়ে পড়ি।
ঈদের আসল আনন্দের স্বাদ তো তখনই পাওয়া যায়। ঈদের চাঁদ উঠল কি না, বারবার টেলিভিশনের দিকে চোখ রাখি। ঘোষণার জন্য অপেক্ষা…যখনই স্ক্রলে আসতে থাকে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে, ব্যস বন্ধুদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে বেরিয়ে পড়ি।
মফস্বল ও ঢাকার দুই জায়গার চানরাতই দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। গাইবান্ধায় যেহেতু বড় হয়েছি, ঈদের আগের রাতে পাড়ার মোড়ে মোড়ে উচ্চশব্দে গান বাজতে থাকত। আমরা খালা-মামাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। তখন অবশ্য এখনকার মতো বিউটি পারলারে যাওয়ার চল ছিল না। ফলে খুব কাছের আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গিয়ে তাদের দাওয়াত দিয়ে আসা হতো। রিকশায় কিছুক্ষণ ঘুরে মার্কেটে যেতাম। ঈদের জামার সঙ্গে মিলিয়ে নেইলপলিশ কেনা, হাতের মেহেদি আর বাসার জন্য দই-মিষ্টি কিনে তবেই বাড়িতে ফিরতাম। ঈদের দিন ঘুরতে পারলাম কি পারলাম না, সেসব নিয়ে মাথাব্যথা থাকত না। কিন্তু চানরাতে ঘোরা চাই–ই চাই।
ঈদের আগের রাতে ভাই মামাদের দেখতাম দল বেঁধে পাঞ্জাবি কিনতে যেতে। শুধু পাঞ্জাবিতে অবশ্য সেই কেনাকাটা থেমে থাকত না। রোদচশমা, সুগন্ধি এমনকি স্যান্ডেলও কিনতেন তাঁরা। রাস্তার পাশে যেখানে তুলনামূলকভাবে কম দামে পোশাক, ঘর–গৃহস্থালির জিনিস পাওয়া যেত, সেখানে জমত বেশি ভিড়। অনেকটা ঢাকার গাউছিয়া, নিউমার্কেট আর চাঁদনী চকের মতো।
ঢাকায় চানরাতে গাউছিয়া, চাঁদনী চকে যেমন যাওয়া হয়েছে, আবার গুলশান-বনানী, কখনো সখনো উত্তরার বিপণিবিতানগুলোতেও ঢুঁ মেরেছি। একই শহরে একই সময়ে স্বল্প আয়ের মানুষও পরিবারের জন্য শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা করেন। আবার উচ্চবিত্তও করেন। একটি বিষয় খুব ভালো লাগে, সবার চোখে-মুখে একধরনের আনন্দ থাকে। যিনি বিক্রি করছেন তাঁরও, যিনি কিনছেন তাঁরও। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সবাই এত ফুরফুরে মেজাজে থাকেন, দেখা যায় একটার জায়গায় তিনটি জিনিস কিনে ফেলছেন। আর অচেনা একজনও হাসিমুখে ঈদ মোবারক বলছেন। এমন দৃশ্য শুধু চানরাতে দেখা যায়।
যে মিষ্টিটা পছন্দের ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় সেটা হয়তো বাড়ির কাছের মিষ্টির দোকানে পাওয়া গেল না। সেটা কিনতেই ছুটতে হয় এক দোকান থেকে আরেক দোকানে। সঙ্গে ঝাল-শুকনো খাবারও কেনা হয়। সুপার শপগুলোতে গিয়ে প্রতিবার লম্বা লম্বা লাইন দিয়ে সালাদের ফল, সবজি কেনা হয়। যে সসটা দিয়ে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা থাকে, সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা থাকে। দীর্ঘ সারি আর মানুষের ঢল দেখে নিজেকে আশ্বস্ত করি, আমার মতো আরও অনেকে আছেন, যাঁরা শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা করছেন।
ঢাকার বিউটি পারলারে এমনকি কোনো কোনো জায়গায় মধ্যরাত পর্যন্ত মেহেদি পরানো হয় হাতে। দল বেঁধে সেই অভিজ্ঞতাও নেওয়া হয়েছে। কোনো বাধাই যেন থামাতে পারবে না। চানরাতে অনেক রাত পর্যন্ত রাস্তাঘাটে মানুষের আনাগোনা থাকে। একবার এক বড় ভাই ও বোনের সঙ্গে চানরাতে বেরিয়ে ছিলাম। রাত দুইটার সময়ও মনে হলো মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে। কয়েকজন ছাত্রকে দেখেছিলাম বন্ধুরা মিলে নিজেদের নকশা করা পাঞ্জাবি রাস্তায় বিক্রি করছেন। এই বাড়তি আয় দিয়ে পরিবারের সবার জন্য কিছু না কিছু কিনেছেন। আর ভোররাতে তাঁরা গ্রামের বাড়িতে রওনা দেবেন।
চানরাতের এই গল্প ভোর হতেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আনন্দের রেশ থেকে যায় পরদিনও। ঈদের আনন্দকে পরিপূর্ণ করে তোলে।