সারা দেশে বেড়েছে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। গ্রাম থেকে শহরের অলিগলি প্রায়শই হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। গুলি করে চুরি, ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। পাড়া-মহল্লার ঝগড়া বিবাদের সূত্র করে ঘটছে গুলির ঘটনা। কিশোর গ্যাংদের হাতে মিলছে অস্ত্র। মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের নেটওয়ার্ক ঠিক রাখতে ব্যবহার করছে অস্ত্র।
সন্ত্রাসী, আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাতে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি তো পুরনো বিষয়।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশে যখন অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি থাকে তখন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। তখন তুচ্ছ কারণেই অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়। সূত্র বলছে, নানা কারণে দেশে এখন অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বেড়ে গেছে অপরাধ প্রবণতা। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অস্ত্র ঢুকছে দেশে। আবার কখনো সীমান্তে কর্মরত বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় চোরাচালানের মাধ্যমে নিয়ে আসা হয় অস্ত্র। সীমান্ত পার হলেই এসব মারণাস্ত্র চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, জঙ্গি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, চরমপন্থিদের হাতে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা দিয়ে ঢুকছে অহরহ আগ্নেয়াস্ত্র। এসব অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। ছোটখাটো অপরাধী থেকে শুরু করে শীর্ষ সন্ত্রাসী-গডফাদাররা মজুত করছে অস্ত্রের ভাণ্ডার। আবার লাইসেন্স নিয়ে অনেকেই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যেভাবে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে আগামীতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি আরো জোরালো ভূমিকা না রাখে তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হবে। এছাড়া অস্ত্রের চালান দেশে প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে আরো বেশি নজরদারি বাড়াতে হবে।
অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, অপরাধীরা সব সময়ই অস্ত্রের মজুত রাখে। শুধু তারা সময়-সুযোগ মতো জানান দেয়ার অপেক্ষায় থাকে। তাই অপরাধী যেই হোক না কেন মূল বিষয়টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। দেখতে হবে তারা কতটুকু তৎপর। কারণ সিন্ডিকেটরাই দেশে অস্ত্রের চালান নিয়ে আসছে। আর এই সিন্ডিকেটদের সহযোগিতা করছে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে তাদের আয়ত্তের বাইরে কি পরিমাণ অস্ত্র আছে। এসব উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি হবে। তিনি বলেন, প্রকাশ্য গুলাগুলির ঘটনাই ভীতির কারণ তৈরি করে দিচ্ছে। আর এসব আগ্নেয়াস্ত্র যদি অপরাধীর কাছে মজুদ থাকে তবে সমাজের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও বেগ পেতে হবে। কারণ যতগুলো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সামাল দিতে হবে। তিনি বলেন, অতীতে জাতীয় নির্বাচনে অস্ত্রের মহড়া, গুলাগুলির ঘটনা ঘটেছে অহরহ। এ ধরনের ঘটনা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।
পুলিশের সাবেক আইজি নুর মোহাম্মদ মানবজমিনকে বলেন, গুলাগুলির ঘটনা দেশে সব সময়ই থাকে। রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যক্তি দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে এসব হয়ে থাকে। তবে নির্বাচনী বছর আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা একটু বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তখন বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। তিনি বলেন, দেশে যে পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করে তার ১০ শতাংশ আটক করা সম্ভব হয়। বাকি অস্ত্র কোনো না কোনোভাবে প্রবেশ করে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে সমুদ্রপথে বিভিন্ন মালবাহী জাহাজের আড়ালে চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র চলে আসে। সীমান্তের দায়িত্বে থাকা বিজিবির পক্ষে সব সময় নজর রাখা সম্ভব হয় না।
গত ১০ই মে রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডার জাগরণী ক্লাবের সামনে আড্ডা দিচ্ছিলেন ৩০ বছর বয়সী আবদুর রাজ্জাক বাবু ওরফে ডিশ বাবু। এ সময় মোটরসাইকেলে করে আসা তিন যুবক বাবুকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়ে। ঘটনাস্থলেই মারা যান বাবু। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাড্ডার বেরাইদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের ছোট ভাই কামরুজ্জামান দুখুকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভাগ্নে ফারুক আহমেদের গ্রুপ প্রকাশ্য গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় গুলিবদ্ধ হয়ে আরো ৫ জন আহত হয়েছিলেন। ২৫শে ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা প্রকাশ্য মহাখালিতে কলেরা হাসপাতালের পেছনে নাসির কাজী নামে ৪৫ বছর বয়সী এক ঠিকাদারকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৩রা মে উপজেলা সদরে নিজ কার্যালয়ের সামনে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে। এ সময় তাকে বহনকারী মোটরসাইকেল চালক রূপম চাকমাও গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পরের দিন ৪ঠা মে সন্ত্রাসীরা ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে চারজনকে। ২৮শে মে সোমবার সকাল ৭টার দিকে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসী দলের হামলায় একটি বাড়িতে অবস্থানরত ইউপিডিএফ সদস্যদের ওপর অতর্কিতে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ঘটনাস্থলেই স্মৃতি চাকমা (৫০), অতল চাকমা (৩০) ও সঞ্জীব চাকমা (৩০) নিহত হন। নিহতদের মধ্যে সঞ্জীব চাকমা গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সদস্য। এই ঘটনায় কানন চাকমা নামে আরো এক ইউপিডিএফকর্মী আহত হয়েছেন। ২৯শে মে পুরান ঢাকার বংশালের সিদ্দিক বাজার এলাকায় দুর্বৃত্তরা লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ উপজেলার ৭ নম্বর বকশিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে গুলি করে আহত করে। বর্তমানে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন।
সূত্র বলছে, বছরের শেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রতিটা জাতীয় নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের নানামুখী ব্যবহার থাকে। পেশিশক্তির প্রদর্শন, প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে ভোট কেন্দ্র দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাসহ নানা কাজে ব্যবহার করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র। অনেক সময় গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি বেশি হলে তখন অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সারা দেশে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ৩ হাজার ১৫০টি। মামলা করা হয়েছে ২ হাজার ৮১টি। ২০১৬ সালে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ৫ হাজার ৭০০টি। মামলা করা হয়েছে ৬২২টি। ২০১৭ সালে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ৫ হাজার ৭৫৫টি। মামলা করা হয়েছে ২ হাজার ২০৮টি। ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ২ হাজার। মামলা করা হয়েছে ৬৯৩টি। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে অস্ত্র মামলা হয়েছে ১৬০টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫৯টি, মার্চ মাসে ১৮০টি ও এপ্রিল মাসে ১৯৪টি। এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপির) তথ্য অনুযায়ী তাদের নিয়মিত অভিযানে ২০১৭ সালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৭৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রাখার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৫২ জনকে এবং বিভিন্ন থানায় মামলা করা হয়েছে ২৬৫টি। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র। ৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করে মামলা করা হয়েছে ২৩টি। ফেব্রুয়ারি মাসে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ১৮টি, ৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করে মামলা হয়েছে ২২টি। মার্চ মাসে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে ২১টি, গ্রেপ্তার ৭৭ জন ও মামলা হয়েছে ৩২টি। এপ্রিল মাসে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ১৮টি। গ্রেপ্তার ৪২ জন ও মামলা করা হয়েছে ২১টি। মে মাসে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ১১টি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪১ জনকে ও মামলা করা হয়েছে ২১টি। জুন মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র। ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করে করা হয়েছে ১৪টি মামলা। জুলাই মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র। ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করে করা হয়েছে ১৯টি মামলা। আগষ্ট মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র। ৪০জনকে গ্রেপ্তার করে করা হয়েছে ২৪টি মামলা। সেপ্টেম্বর মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ২টি আগ্নেয়াস্ত্র। ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করে করা হয়েছে ১০ মামলা। অক্টোবর মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করে ৩১টি মামলা করা হয়েছে। নভেম্বর মাসে ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করে ২১টি মামলা করা হয়েছে।
একই বছরের ডিসেম্বরে উদ্ধার করা হয়েছে ২১টি আগ্নেয়াস্ত্র। ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করে ২৭টি মামলা করা হয়েছে। চলতি বছরে জানুয়ারী মাসে ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা ২১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ১৫টি। ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে ১৫টি মামলা করা হয়েছে। মার্চ মাসে ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করে ১৯টি মামলা করা হয়েছে। এবং এপ্রিল মাসে ১০৯টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করে ১৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ডিএমপির উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে রয়েছে, ২৬টি রিভলবার, ৯৭টি বিদেশি পিস্ত, ২৭টি দেশি পিস্তল, ১টি এসএমজি, ৪টি পাইপগান, ১৭টি শাটারগান, ৬টি দেশি রিভলবারসহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে শুধু ঢাকার বিভিন্ন জজ আদালতে ৫ হাজার ৩৫৬টি অস্ত্র মামলা বিচারাধীন রয়েছে। রয়েছে ৫৫টি তদন্তাধীন মামলা। আর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টার (বিডিপিসি) বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় দেশে ৪ লাখের মতো অবৈধ অস্ত্র মজুত আছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, অস্ত্র উদ্ধারে সারা দেশে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যর ভিত্তিতে পুলিশ এসব অস্ত্র উদ্ধার করে। এর বাইরে যদি কারো কাছে অবৈধ অস্ত্র থেকে থাকে তবে তাদেরকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে।