বিশ্বকাপের ট্রফির বিবর্তন হয়েছে দু’বার। এখন যে সোনালী ট্রফিটা বিজয়ের স্মারক হিসেবে বিজয়ীর হাতে তুলে দেয়া হয়, সেটি কিন্তু প্রথম বিশ্বকাপ থেকে ছিল না। ছিল অন্য আরেকটি ট্রফি। ১৯৫০ সালে এসে বিশ্বকাপের স্বপ্নদ্রষ্টা, তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমের নামে নাম করণ করা হয়, ‘জুলে রিমে’ ট্রফি। যেটি ১৯৭০ সালে চিরতরে ব্রাজিলকে দিয়ে দেয়া হয়। কারণ, প্রথম দল হিসেবে তিনবার বিশ্বকাপ জয় করার কারণে, ওই ট্রফিটির চিরস্থায়ী মালিক হয়ে যায় ব্রাজিল।
১৯৭৪ সালে নিয়ে আসা হয় বর্তমান ট্রফিটি। ইতালির ভাস্কর সিলভিও গাজ্জানিগা এই ট্রফির ডিজাইন প্রস্তুত এবং নির্মাণ করেন। তো, বর্তমান বিশ্বকাপ ট্রফির ভাগ্যে তেমন কিছু না ঘটলেও, জুলে রিমে ট্রফির ওপর বারবার হামলে পড়েছে তস্করের দল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ওই ট্রফিটার ওপর শ্যেন দৃষ্টি ছিল জার্মান নাৎসি বাহিনীর। শেষ পর্যন্ত দুই দফায় চুরির পর অবশেষে সেই জুলে রিমে ট্রফির মূল অস্তিত্বই হারিয়ে গেছে।
১৯৬৬ বিশ্বকাপের আয়োজক ইংল্যান্ড। প্রথমবারেরমত রাণীর দেশে বিশ্বকাপের আয়োজন হচ্ছে। যে কারণে পুরো ব্রিটেনজুড়ে উৎসব আর উৎসব। বিশ্বকাপের ঠিক আগে (মার্চ মাসে) লন্ডনে প্রদর্শণীর আয়োজন করা হয়। যেখানে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছিল বিশ্বকাপ ট্রফিটি। তবে ট্রফি প্রদর্শণের আগে ফিফা ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে (এফএ) শর্ত দেয়, সর্বদা ট্রফিটিকে পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। একই সঙ্গে ইন্স্যুরেন্স করতে হবে ৩০ হাজার পাউন্ডের। যদিও ট্রফির আসল মূল ছিল মাত্র ৩ হাজার পাউন্ড (তখনকার সময়ে)।
ওয়েস্ট মিনিস্টার সেন্ট্রল হলে প্রদর্শনী শুরু হয়। ১৯ মার্চ, ১৯৬৬ সালে। দু’জন করে ইউনিফর্মধারী গার্ড ২৪ ঘণ্টা ট্রফিটিকে পাহারা দিচ্ছিল। আরও একজন গোয়েন্দা টাইপের গার্ড দুর থেকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখছিল প্রদর্শনীতে আসা দর্শনার্থী এবং ট্রফিটির দিকে। বিশ্বকাপের আগে এই প্রদর্শনী নিয়ে লন্ডনের মানুষের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ তৈরী হয়। সবারই আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু ছিল, খাঁটি সোনায় তৈরি জুলে রিমে ট্রফিটির দিকে।
প্রদর্শনী খোলা থাকলেও ট্রফিটিকে সব সময় দেখার সুযোগ ছিল না দর্শনার্থীদের জন্য। কারণ, রোববার ধর্মীয় কারণে সেন্ট্রাল হল প্রদর্শণের জন্য খোলা থাকতো না। দিনটি ছিল ২০ মার্চ, রোববার। প্রদর্শণীছাড়া ট্রফি ক্যাবিনেটটি দুটি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। ওইদিনই সুযোগবুঝে কোনো এক সময়ে ট্রফিটি চুরি করে নিয়ে যায় চোরের দল।
দুপুর ১২টিা ১০ মিনিটে গার্ডরাই জানায়, ট্রফিটি যে ক্যাবিনেটে রাখা ছিল সেটির পেছনের দরজা ভাঙা। তার ওপর প্রদর্শনী সেন্টারের ফ্লোর ছিল কাঠের। চোরের দল ওয়েস্ট মিনিস্টার সেন্টারের পেছনের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এবং কাঠের ফ্লোরের স্ক্রু খুলে ভেতরে প্রবেশ করে তালা ভেঙে ট্রফিটি চুরি করে নিয়ে যায়।
ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে পুরো কেসটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। গ্রেফগার করা হয় গার্ডদের। ওয়েস্ট মিনিস্টার হলের যত কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং নিরাপত্তারক্ষী ছিল, সবাইকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। চার্চে আগন্তুকদেরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়; কিন্তু কোনো কুল-কিনারা করতে পারছিল না স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। পরদিন সারা বিশ্বে গুরুত্বসহকারে প্রকাশ হয়ে যায় বিশ্বকাপ ট্রফি চুরির ঘটনা। সুতরাং, আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে পড়ে যায় ইংল্যান্ড সরকারও।
২১ মার্চ এফএ চেয়ারম্যান জো মেয়ার্স একটি অপরিচিত কল পান। অপরিচিত কণ্ঠ মেয়ার্সকে জানান, চেলসি ফুটবল ক্লাবে পরেরদিন তিনি একটি পার্সেল পাবেন। পরে সেই পার্সেলটি পৌঁছে দেয়া হয় মেয়ার্সের বাসায়। যেখানে ছিল, চুরি যাওয়া ট্রফির উপরিভাগের ছোট্ট একটি অংশ এবং একটি মুক্তিপনের চিঠি। যেখানে লেখা ছিল, ট্রফিটি পেতে হলে ১৫ হাজার পাউন্ড মুক্তিপন দিতে হবে।
তাও এই ১৫ হাজার পাউন্ডের নোটগুলো হবে সব ১ থেকে ৫ পাউন্ডের। সেখানে আবার বলা হয়, এফএ’র উচিৎ হবে দ্য ইভিনিং নিউজে একটি কোডেড বিজ্ঞাপন প্রচার করা। যদি তাদের নির্দেশনা মানা হয়, তাহলে পরের শুক্রবার ট্রফিটি ফিরিয়ে দেয়া হবে। তা না করে যদি পুলিশে জানানো হয় কিংবা সংবাদপত্রে প্রচার করা হয়, তাহলে ট্রফিটি গলিয়ে ফেরা হবে এবং এর অস্তীত্ব আর কখনও পাওয়া যাবে না। ওই মুক্তিপন চিঠি পাওয়ার কিছুক্ষণ পর আবারও একটি কল আসে মেয়ার্সের টেলিফোনে। সেখানে বলা হয়, মুক্তিপনের পাউন্ডগুলো হবে ৫ থেকে ১০ পাউন্ডের নোটের।
হুমকি সত্ত্বেও মেয়ার্স পুলিশের গোয়েন্দা অফিসার চার্লস বাগির সঙ্গে দেখা করেন। তার কাছে ট্রফি লাইন এবং চিঠিটি হস্তান্তর করেন। পুলিশ অফিসার মেয়ার্সকে বলেন, চোরদের কথা অনুসারে ২৪ মার্চ একটি বিজ্ঞাপন দিতে এবং ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু ভূয়া নোট দিয়ে বান্ডিল তৈরি করে স্যুটকেস ভর্তি করতে। সেই বান্ডিলের উপরের এবং নিচের নোট দুটি হবে অরিজিনাল এবং ভেতরেরগুলো হবে ভুয়া। তিনি স্যুটকেসটি নিয়ে চোরদের দেখানো জায়গায় চলে যাবেন। সাধারণ পোষাকে দু’জন পুলিশ থাকবেন মেয়র্সের সহকারী হিসেবে।
এরই মধ্যে একটি সমস্যা দেখা দেয়। মেয়ার্স শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করেন। যে কারণে চোরদের দেয়া ফোন রিসিভ করেন তার স্ত্রী। ‘জ্যাকসন’ নামে এক ব্যাক্তি ফোন করেছিলেন। মেয়ার্সের স্ত্রী তাকে অসুস্থতার বিষয়টা জানিয়ে অনুরোধ করেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ অফিসার বাগির সঙ্গে আলাপ করতে। কারণ, তিনিই এ বিষয়ে কথা বলতে পারবেন। তবে, পুলিশের পরিচয়টা প্রকাশ করেননি মেয়ার্সের স্ত্রী। ‘জ্যাকসন’ প্রথমে একটু ভয় পেলেও সিদ্ধান্ত নিলেন কথা বলবেন। তবে বাগিকে তিনি জানিয়ে দেন, ব্যাটেরেসা পার্কে সাক্ষাতের জন্য।
বাগি নিজে ড্রাইভ করে সেই পার্কে উপস্থিত হন। তাকে অনুসরণ করছিল সাধারণ পোষাকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ফ্লাইং স্কোয়াডের সদস্যরা। বাগি সেই জ্যাকসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাগি তাকে স্যুটকেস দেখান। কিন্তু জ্যাকসন বুঝতেই পারেননি সেখানে সব ভূয়া নোট রাখা। বাগি আবার জ্যাকসনকে বলেন, স্যুটকেস হস্তান্তরের আগে তিনি ট্রফিটা দেখতে চান। না হয়, কেউ যদি স্যুটকেস এবং ট্রফিসগ তাকে আবার অপহরণ করে। জ্যাকসন রাজি হয় এবং তাকে ট্রফি রাখার জায়গায় নিয়ে যাবে বলে জানায়।
কথামত বাগির গাড়িতে করে রওয়ানা দেয় জ্যাকসন। গাড়ীতে থাকতেই তিনি বুঝতে পারেন, গোয়েন্দা পুলিশ তাদেরকে অনুরসরণ করছে। কেনিংটন পার্ক রোডে এসে গাড়ি থামতে ট্র্যাফিক সিগন্যালে। জ্যাকসন হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে যায় এবং বলে, তিনি ট্রফিটি নিয়ে আসতে যাচ্ছেন। দ্রুত রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি গাড়ি তার পাশে থেমে যায়। হঠাৎ কোনায় হারিয়ে যায় জ্যাকসন। বাগি উদ্যোগ নেন তাকে ফলো করার। তখনই আবার জ্যাকসনকে দেখা যায়। তিনি গাড়ীতে উঠে বসেন। বাগি যখন আবার নিজের গাড়িটি চালানো শুরু করে, হঠাৎ জ্যাকসন লাফ দিয়ে আরেকটি দ্রুতগতির গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং পালিয়ে যায়। পুলিশ অফিসার বাগি এবং তার দল জ্যাকসনের গাড়িটি ধাওয়া করে।
শেষ পর্যন্ত একটি বাড়ির বাগানে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পরে জানা গেলো সেই জ্যাকসন হচ্ছে মূলত চিঁচকে চোর টাইপের। সে শুধু প্রতারণা করে ঘটনার সুবিধা নিতে চেয়েছিল। তার আসল নাম এডওয়ার্ড বেচলি। তার কাছ থেকে অনেক চুরি করা মালামাল উদ্ধার করা হয়। তবে সে প্রস্তাব দেয়, যদি জামিন দেয়া হয় তাহলে চুরি যাওয়া ট্রফিটি উদ্ধার করতে সহায়তা করবে। কিন্তু পুলিশ তার আবেদন আর গ্রহণ করেননি।
এভাবে কেটে যায় আরও দুইদিন। ২৬ মার্চ হঠাৎ জিপসি হিল থানায় হাজির হন ২৬ বছরের তরতাজা এক যুবক। হাতে কাগজে মোড়ানো জুলেরিমে ট্রফি। আর সঙ্গে একটি কুকুর। ডেভিড করবেট নামে সেই যুবকটি পুলিশকে জানায়, তার ২ বছর বয়সী কুকুর পিকলেসই হচ্ছে চুরি যাওয়া এই ট্রফিটির সন্ধানদাতা। বেউলাহ হিলে তিনি কুকুর পিকলেসকে নিয়ে মর্নিংওয়াক করছিলেন। সেখানেই জঙ্গলর মধ্যে একটি জায়গার দিকে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল পিকলেস। সেখানে গিয়েই পুরনো কাগজে মোড়ানো ট্রফিটি দেখতে পান তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গেই সেটি নিয়ে থানায় চলে আসেন। সেখানেই পুলিশের কাছে তিনি ট্রফিটি হস্তান্তর করেন।
জিপসি হিল থানার পুলিশ ট্রফি, ডেভিড করবেট এবং কুকুরটি নিয়ে চলে আসে ক্যানো রো থানায়। সেখানে এফএ কর্মকর্তা হ্যারল্ড মায়েস ট্রফিটি চিহ্নিত করেন, আসল হিসেবে। পুলিশ প্রথমে ডেভিড করবেটকে গ্রেফতার করে। কারণ, পুলিশের সন্দেহ হয় তিনি এই চুরির কাজের সঙ্গে জড়িত। তবে করবেট পরে প্রমাণ করতে সক্ষম হন, তিনি জড়িত নন।
ট্রফি উদ্ধার করার কারণে ‘সেলিব্রেটি’ হয়ে যায় কুকুর পিকলেস।.কয়েকটি টিভি শো, এমনকি সিনেমাতেও ডাক পড়ে তার। বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে ফিফা ইংলিশ ফুটবলারদের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানায় কুকুরটির মালিককে এবং তার হাতে তুলে দেয় ছয় হাজার পাউন্ডের চেক।
তবে জুলে রিমে ট্রফি চুরি হয়ে যাওয়ার কারণে ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন তড়িগড়ি করে বিশ্বকাপের জন্য একটি রেপ্লিকা ট্রফিও তৈরি করে নিয়েছিল। পরে মূল ট্রফিটি উদ্ধার হওয়ার পর রেপ্লিকা ট্রফিটি সংরক্ষণ করা হয়েছে ইংলিশ ন্যাশনাল ফুটবল মিউজিয়ামে।
প্রথম দফায় চোর জুলেরিমে ট্রফিটি হজম করতে না পারলেও দ্বিতীয় দফায় চিরতরে চোরের কব্জায় চলে যায় বিশ্বকাপ ট্রফিটি। ১৯৭০ সালে ৩ বার বিশ্বকাপ জয়ের সুবাদে জুলে রিমে ট্রফির চিরতরে মালিক হয়ে যায় ব্রাজিল; কিন্তু এই গর্বের ধন আগলে রাখতে পারেনি ব্রাজিলিয়ানরা। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশন অফিসের শো-কেস থেকে আবারও চুরি হয়ে যায় জুলে রিমে ট্রফিটি। এবার আর চোর প্রথমবারের মত ভুল করেনি। চুরি করার সঙ্গে সঙ্গেই কাপটিকে গলিয়ে ফেলে তারা। বিশ্বকাপ ট্রফির ১ কেজি ৮০০ গ্রামের নিরেট স্বর্ণ চোরচক্রের কাছে ছিল ভীষণ দামি।
এখনও ব্রাজিলে আছে সেই জুলে রিমে ট্রফি। তবে তা নকল। এই জুলে রিমে ট্রফি নিয়ে কম নাটক হয়নি। ১৯৩৮ সালে বিশ্বকাপ জেতে ইতালি। স্বাভাবিক কারণেই তখন ট্রফিটি ইতালি। ইতালি ফুটবল ফেডারেশন সেটি রক্ষিত রাখে একটি ব্যাংকে।
১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বিশ্বকাপের পরবর্তী আসর। কিন্তু এরই মধে বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। তখন ওই ট্রফিটি হেফাজতে ছিল ফিফার সহ-সভাপতি ড. ওডেরিসো বারোসির।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসীদের হাত থেকে কাপটিকে বাঁচানোর জন্য এক অভিনব কৌশল নেন ড. বারোসি। তিনি খুব সন্তর্পনে এটিকে একটি ব্যাংক থেকে তুলে রোমে নিয়ে যান এবং একটি জুতার বাক্সের ভেতরে ভরে তার নিজের খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন। দেখলে মনে হতো, চরম অবহেলায় পরিত্যক্ত কোনো জিনিস তিনি ফেলে রেখেছেন। এভাবেই নাৎসীদের চোখে ধুলে দেন বারোসি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেলেও শেষ রক্ষা হয়নি জুলে রিমে ট্রফিটির।