‘যদি ফুটবল শিখতে চান, আপনাকে যেতে হবে আর্জেন্টিনায়’-অনেক বছর আগে কথাটা বলেছিলেন পেপ গার্দিওলা। কোচিং তখনো শিখছিলেন স্প্যানিশ কোচ। কথাটা বলেছিলেন দুই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি কোচের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর। একজন ১৯৭৮ বিশ্বকাপজয়ী কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি, অন্যজন ফুটবলভক্তদের কাছে হয়তো ঠিক তত বড় নাম নন, তবে কোচদের ‘গুরু’-মার্সেলো বিয়েলসা।
আসলে তাই। এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে শুধু খেলোয়াড়দেরই নয় বরং মিলন মেলা ঘটবে আর্জেন্টিনার কোচদেরও। সাম্পাওলি ছাড়াও আরো চারজন আর্জেন্টিনার কোচকে দেখা যাবে ভিন্ন দলের হয়ে। বিষয়টি খুবই চমৎকার।
আর্জেন্টিনার তো আর্জেন্টাইন ছাড়া আর কাউকে কোচ না করাই স্বাভাবিক। ফুটবলীয় গর্বের প্রশ্ন বলে কথা! সেখানে হোর্হে সাম্পাওলি আছেন, পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকান আরো দুই দেশেরও কোচ আর্জেন্টাইন-কলম্বিয়ায় হোসে পেকারম্যান, পেরুতে রিকার্দো গারেকা। এর বাইরে মিসরে আছেন হেক্টর কুপার আর সৌদি আরবে হুয়ান আন্তোনিও পিজ্জি।
তা আর্জেন্টাইন কোচদের নিয়ে এত আগ্রহ কেন? সেটির একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আর্জেন্টিনাকে ১৯৭৮ বিশ্বকাপ জেতানো স্ট্রাইকার মারিও কেম্পেস, ‘ (আর্জেন্টাইন কোচদের) চারিত্রিক দৃঢ়টা, কাজটা করার মতো ব্যক্তিত্ব আছে।’ আরেকটু বিশ্লেষণ এসেছে আর্জেন্টাইন মানবসম্পদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ম্যানপাওয়ারগ্রুপে’র নির্বাহী গুস্তাভো আগিলেরার কাছ থেকে, ‘তারা নতুন ধারণার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন, বিশেষত অনিশ্চয়তাপূর্ণ পরিস্থিতিতে। যেকোনো সমস্যার ভালো সমাধানও খুঁজে নিতে পারেন তারা।’
পাঁচ দলের পাঁচ মহারথী।
এসব গুণের নেপথ্যে গত দশকে দেশটিতে যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ছিল, সেটিরও ‘অবদান’ আছে। সে সময় প্রতি পাঁচজন আর্জেন্টাইনের একজন ছিলেন বেকার। কয়েক লাখ পড়েছিলেন দারিদ্র্যের কবলে। ‘এই কোচরা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যাওয়া পরিস্থিতিতেও কাজ করে অভ্যস্ত’-বলছিলেন আগিলেরা। এর সঙ্গে আর্জেন্টিনার মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশার চাপ যোগ করে নিন। সেরার চেয়ে কম কোনো কিছুই যে সেখানে ব্যর্থতার অন্য নাম। সেসবই হয়তো কোচদের জন্য হয়ে আসছে আশীর্বাদ। চারিত্রিক দৃঢ়তা তো কঠিন পরিস্থিতি থেকেই আসে!
সৌদি আরবে পিজ্জিকে যে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে নিশ্চিত। রাশিয়া-উরুগুয়ে-মিসরের গ্রুপে পড়েছে দলটা, বিশ্বকাপে দলগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন র্যাঙ্কিং খেলোয়াড়দের মান নিয়েও ধারণা দেয়। তার ওপর পিজ্জি দায়িত্ব নিয়েছেন মাত্র এক মাস হলো, সেটিও আবার সাবেক আর্জেন্টিনা কোচ এদগার্দো বাউজার বদলি হয়ে। পিজ্জি অবশ্য হুংকার দিতে ভুলছেন না, ‘আমরা রাশিয়ায় অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো অবস্থায় থাকব!’
গ্রুপে সর্বশেষ ম্যাচটিতেই পিজ্জি মুখোমুখি হবেন স্বদেশি কুপারের। সৌদি আরব বনাম মিসর। কুপার অবশ্য এরই মধ্যে মিসরের মানুষের মন জিতে নিয়েছেন। ১৯৯০ সালের পর মিসরের প্রথম বিশ্বকাপে ওঠার পেছনে মোহামেদ সালাহর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের অবদান তো আছেই, ২০১৫ সালে দলটার দায়িত্ব নেয়া কুপারও পাচ্ছেন প্রশংসা। অথচ এর আগে কৌশল নিয়েই মিসরের সংবাদমাধ্যমে অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছে তাকে।
কুপারের মতো আগে কখনো জাতীয় দলের দায়িত্ব নেননি, কিন্তু কুপারের মতোই ২০১৫ সালে দায়িত্ব নিয়ে একটা দেশের দীর্ঘ অপেক্ষা ঘুচিয়েছেন-এই বিশ্বকাপে এমন আরেক আর্জেন্টাইনও আছেন। পেরুর রিকার্দো গারেকা। ৩৬ বছর পর দেশটাকে এনেছেন বিশ্বকাপে। মজার ব্যাপার কী,১৯৮৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে এই গারেকার গোলেই পেরুকে হারিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা! তা দায়িত্ব নিয়েই পেরু দলটাকে গারেকা গড়েছেন বল দখলে রেখে আর্জেন্টাইন ছন্দে ছোট ছোট পাসে খেলার কৌশলে। গ্রুপে ফ্রান্সই হয়তো সেরা হবে, তবে দ্বিতীয় স্থানের জন্য অস্ট্রেলিয়া ও ডেনমার্কের সঙ্গে ভালোই লড়তে পারে পেরু।
ছয় বছর ধরে কলম্বিয়ার দায়িত্বে থাকা হোসে পেকারম্যানের লড়াইটা অন্য। গত বিশ্বকাপে যে চমক দেখিয়েছে কলম্বিয়া, সেটিকে এবার ‘ফ্লুক’ নয় প্রমাণ করা। হামেস রদ্রিগেজে উজ্জ্বল কলম্বিয়া ২০১৪ বিশ্বকাপে উঠেছিল কোয়ার্টার ফাইনালে, দেশটির বিশ্বকাপ ইতিহাসে যা সেরা সাফল্য। কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পেকারম্যানের এর আগেও হয়েছে, ২০০৬ বিশ্বকাপে নিজ দেশ আর্জেন্টিনাকে নিয়ে। এবার তেমন কিছু করতে আগে অবশ্য সেনেগাল, পোল্যান্ড ও জাপানকে নিয়ে গড়া বিশ্বকাপের তর্ক সাপেক্ষে সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে কলম্বিয়াকে।
অন্য চার দেশের চারজনের কথা হলো, বাকি শুধু আর্জেন্টিনার আর্জেন্টাইন কোচ-সাম্পাওলি। গত জুনে দায়িত্ব নিয়েছিলেন যখন, আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপে যাওয়াই ঘোর অনিশ্চয়তায়। এখন বিশ্বকাপে যাচ্ছেন দলকে বিশ্বসেরা করার চাপ নিয়ে। এক লিওনেল মেসি আছেন বলেই হয়তো ভরসা! গত বিশ্বকাপে চিলিকে নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে থেমে গেলেও পরের বছরই মেসির আর্জেন্টিনাকে হারিয়েই এনে দিয়েছিলেন চিলির ইতিহাসে প্রথম কোপা আমেরিকা।